‘দ্য বুক থিফ’ শুরু হয় লং শটে ! মেঘের দৃশ্য দিয়ে যেন বিরাট এক পটভূমিকে খুব সরল উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রকার বুঝাতে চান জার্মান সাধারণের বিশ্বযুদ্ধকালীন জীবন।
স্টিম ইঞ্জিনের রেল একটি পরিবারকে নিয়ে যায় কোথাই যেন ! ১২ বছরের লিসেলকে দেখি আর দেখি তার ভাইয়ের মৃত্যু। লিসার মা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য এবং স্বভাবতই হিটলারের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার ! লিসেল মিমিঞ্জারের আশ্রয় হয় রোজা হুবারম্যান এবং হান্স হুবারম্যানের ঘরে ! এই নি:সন্তান দম্পতী লিসেলকে দত্তক নেয়। রোজা এবং হান্স চরিত্রের মাধ্যমে দেখি শিশুসুলভ সরলতা। একরডিয়নের সুরে হান্স হুবারম্যান যুদ্ধকে ভুলিয়ে দিতে চান। জার্মান অঞ্চল বাভারিয়া এবং একটি অনিন্দ সুন্দর চলচ্চিত্রের শুরু।
শুরুর একটি সিকোয়েন্স যুদ্ধকালীন জার্মান অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বুঝতে সহায়ক হয় যখন আমরা দেখি হুবারম্যান দম্পতী লিসেল মিমিঞ্জারকে একা দেখে ক্ষুব্ধ হন যেহেতু তাদের দত্তক নেওয়ার কথা ছিলো দুইজনকে (লিসেল এবং তার ভাই)। কিন্তু আসার পথে প্রচন্ড শীতে লিসেলের ভাই মারা যায় এবং এর ফলে বড় সরকারি ভাতা পাওয়া থেকে হুবারম্যান দম্পতী বঞ্চিত হন ! যদিও তাদের এই সাময়িক লোভ শুধুমাত্র আর্থিক দৈন্যকে প্রকাশ করে কিন্তু তাদের মনকে নই।বাভারিয়ার ছোট্ট আবাসস্থলে বেশকিছু পরিবারের জীবনকে নিয়েই শুরু হয় ‘দ্য বুক থিফ’। রোজা হুবারম্যান বদরাগি মানুষ কিন্তু হান্স হুবারম্যানের সাথে তার সংসারটা সুখের। লিসেলকে আপন সন্তানের মতোই মানুষ করতে থাকেন তারা। বাভারিয়াতে তখনো শীত নামেনি কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। লিসেলের পরিচয় হয় সমবয়সি হুডি স্টাইনারের সাথে। হুডি অন্যান্য জার্মান বালকদের কাছে চক্ষুশূল যেহেতু হুডি স্টাইনার স্বপ্ন দেখে একদিন দুরন্ত জেসি ওয়েন্স হওয়ার। মার্কিন অলিম্পিক কিংবদন্তী কালো মানব জেসি ওয়েন্স ! হুডি স্টাইনার দৌঁড়ে জিততে চাই লিসেল মিমিঞ্জারের মন আর সেই চুমু যা কিনা কখনোই পায়না সে !
দুইটা বিষয় চলচ্চিত্র হিসেবে ‘দ্য বুক থিফ’কে’ অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। প্রথমত, লিসেল মিমিঞ্জারের জীবন যেখানে ইহুদি বালিকা আনা ফ্রাঙ্কের জীবনের মিল আছে এবং দ্বিতীয়ত, যুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে দর্শকের মনে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে দেখানো ! ভিজ্যুয়ালি এবং কালার ইম্প্রোভাইজেশন একটা সময়কে উপস্থাপন করে। সিনেমার বড় অংশ জুড়ে নাজি পতাকার রঙের তীব্রতা যেন নিষ্ঠুর হিটলারের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। শুধুমাত্র লং এবং মিড শটের ব্যাবহারে এবং কখনো একরডিয়ন আর পিয়ানো টিউন দর্শককে একটি সময়ের প্রবাহে নিয়ে যেতে থাকে। ১৯৩৮ এর ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৪৫ এর গ্রীষ্মে বাভারিয়া এবং স্টুটগার্ট কালার ইম্প্রেশনিজমে বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে। আমরা দেখি লিসেল মিমিঞ্জারকে ! বাভারিয়ার রাস্তায় নাজিদের বই পোড়ানোর উৎসব চলে। কট্টর জার্মান সংস্কৃতি ভিন্ন আর কিছুই রাখতে চাননা এডলফ হিটলার ! উগ্র জাতীয়তাবাদ জার্মান সাধারণকে ধ্বংস করতে থাকে। সেই আগুনের স্তুপ থেকে লিসেল যে বইটি কুড়িয়ে নেয়, তা ছিলো এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যান’। বাপ মেয়ে মিলে গভীর রাত অব্দি বই পড়া চলতে থাকে।
লিসেল মিমিঞ্জারের সময় যেতে থাকে স্কুলে এবং মহল্লায় হুডি স্টাইনারের সাথে। হুডি স্টাইনার লিসেলকে ভালবেসে ফেলে কিন্তু এটা ছিলো দারুণ এক বন্ধুত্ব যেখানে সারল্য এবং সৌন্দর্যই ছিলো মুখ্য। ঠিক ঐ সময়টাতেই স্টুটগার্ট থেকে পালিয়ে আসে ম্যাক্স ব্রান্ডেনবার্গ ! বছর পঁচিশের ইহুদি যুবক। সে আশ্রয় পায় হুবারম্যানের ঘরে। হান্স হুবারম্যান ইহুদি নন কিন্তু তিনি আশ্রয় দেন ইহুদি ছেলেকে। তিনি ম্যাক্স ব্রান্ডেনবার্গের পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ যেহেতু আগের যুদ্ধে হুবারম্যানের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাক্সের বাবা !…
এতো কিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় চলচ্চিত্রের নাম নিয়ে! বই চোর ! এক্ষেত্রেই পরিচালক ব্রাইয়ান পারসিভ্যাল দারুণ মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। চলচ্চিত্রের মূল উপাদান হয়ে যায় এটি যেহেতু একদিকে চাপিয়ে দেওয়া উগ্র জাতিয় সংস্কৃতি অন্যদিকে মানুষের ব্যক্তিচেতনাবোধের সৌন্দর্যের লড়াই। লিসেল লুকিয়ে যে প্রাসাদোপম অট্টালিকা থেকে বই চুরি করতো তা ছিলো অন্য একটি নি:সঙ্গ অভিজাত জার্মান পরিবারের আবাসস্থল। বিশাল বাড়িটিতে যারা থাকতো, তারাও হিটলারের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলো হাজারো বই ! লিসেল সেই বিরাট লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করতো আর তা পড়ে শোনাতো তাদেরই বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড এপার্টমেন্টে আত্নগোপনে থাকা ম্যাক্স ব্রান্ডেনবার্গকে ! অন্ধকার ঘরে ম্যাক্সকে বই পড়ে শোনানো আর ওয়েদার রিপোর্ট বলাতেই ছিলো লিসেলের আনন্দ। লিসেল বইয়ের পাতা পর পাতা মুখস্থ করে রাখে আর শোনায় ম্যাক্স ব্রান্ডেনবার্গকে। একটা সিকোয়েন্সে লিসেল এবং ম্যাক্সের কথোপকথন যেন পুরো চলচ্চিত্রের ভিত্তি…ম্যাক্স বলে…
“Memory is described of the Soul. Do you know who said that? A man called
Aristotle. Can you do me a favor? Can you describe the day for me?লিসেল জবাব দেয়…’It’s Cloudy’ !
…. এভাবেই ডায়ালগ এবং মিউজিক ‘দ্য বুক থিফ’ চলচ্চিত্রটিকে মায়াময় বিষন্নতায় ডুবিয়ে রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ হয়ে আসে…জার্মানদের পরাজয় আসন্ন, গেস্টাপো বাহিনী ঘরে ঘরে তল্লাসি চালাতে থাকে শেষ ইহুদি মানুষটিকেও ধ্বংস করার জন্য ! ম্যাক্স ব্রান্ডেনবার্গ আর বিপদে ফেলতে চাইনা হুবারম্যানদের। গভীর রাতে হুবারম্যান পরিবারকে বিদায় জানায় ম্যাক্স ! লিসেল যেন এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারেনা। যুদ্ধ মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়।
‘দ্য বুক থিফ’ চলচ্চিত্রের শেষটা বিয়োগান্তক কিন্তু সম্ভাবনা এবং স্মৃতিকে আপন করে নেওয়ার ভিজ্যুয়াল ইমেজ। ক্যারিশম্যাটিক জীবনের সিনেমা ! হুডি স্টাইনারের সাথে বাভারিয়ার বনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে লিসেল মিমিঞ্জার আবিষ্কার করে, তারা দুজনেই ঘৃণা করে হিটলারকে ! চলচ্চিত্রের শেষটা হয় মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণের মধ্যে। পুরো মহল্লা ধ্বংস হয় ! মারা যান সরল মহৎ হুবারম্যান দম্পতী এবং উচ্ছলসৌন্দর্যের প্রতীক হুডি স্টাইনার। ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখকের কন্ঠ ! ব্রাইয়ান পারসিভ্যালের ‘দ্য বুক থিফ’ উপন্যাসের এডাপটেশন কিন্তু নির্মাণে নিপুণ। হান্স হুবারম্যান চরিত্রে জিওফ্রে রাশ দুর্দান্ত। আর সবকিছু ছাপিয়ে ১২ বছরের লিসেল মিমিঞ্জার যেন হয়ে ওঠে মানবতার স্মৃতিচিহ্ন ! ‘দ্য বুক থিফ’ বই চোরের গল্প না। ‘দ্য বুক থিফ’ এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যান’ এবং লিসেল মিমিঞ্জারের বিশ্বযুদ্ধকালীন জীবন।