গত কাল একটি পোষ্ট করেছিলাম ৭১ এ জামায়েত ইসলামের ভুমিকা নিয়ে । এর জন্য বিশেষ একটা কারণ ছিলো , জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সংঙ্গীত পরিবর্তনের একটা প্রস্তাব এসেছে তাদের এক নেতা / কর্মীর কাছ থেকে সেই প্রসংগে আমি বলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে জামায়েতের ভুমিকা নিয়ে একটা ক্লিয়ার বক্তব্য তাদের দল থেকে দিলে , এবং যদি ওই সময়ের ভুল গুলোর জন্য তারা অনুশোচনা করে কিংবা ক্ষমা চেয়ে নেয় তাহলে রাজনীতির দিক থেকে এটি তাদের জন্যই ভালো । এইটা যে আমিই প্রথম বলেছি বিষয়টা এমন না , তাদের দল থেকে পদত্যাগ করা একজন প্রথম সারির নেতাও এই প্রস্তাব গুলো দিয়েছেন । এমন কি দলের নাম পরিবর্তনের কথাও ওই নেতা বলেছেন । কিন্তু তারা সেটি করে নাই , কিংবা এর জন্য কোন পদক্ষেপ ও নেয় নি । সেই জায়গাতে তারা একটি দেশের জাতীয় সংগীত এবং পতাকা পরিবর্তন করতে বলে কিভাবে ? যদিও পূর্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে জামায়েত এর পক্ষ থেকে অন্য প্রসংগে নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয় লক্ষ করা গেছে সুতরাং এইবার ই নতুন তা বলা যায় না ।
এতো কিছু বলার জন্য এই লম্বা পোষ্ট নয় , এই পোষ্ট টি হলো , আমার মন্তব্যের বিপরীতে জামায়েতের অনেক শুভাকাঙ্খী অধ্যপক গোলাম আজমকে একজন প্রথম সারির ভাষা সৈনিক বলে দাবী করছেন সেটি নিয়ে, ২০২৪ এই যে এমন দাবী করছেন তারা বিষয়টা একেবারেই এমন নয়, কেন না এর আগেও তারা একটি ক্যাসেট বের করে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, যেখানে গোলাম আযম কে একজন প্রথম সারির ভাষা সৈনিক দাবী করা হয়েছ – চলেন একটু দেখে আসি অধ্যপক গোলাম আজম ভাষা আন্দোলনে তার ভুমিকা কেমন ছিলো , এবং এর পরবর্তীতে তার মন্তব্য সমূহ –
গোলাম আযমকে একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তার অনুসারীরা বাজারে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে একটা সিডি তারা ছেড়েছে। এবং তাতে বদরুদ্দিন উমরসহ বেশ কজন বিশিষ্ট মানুষের নাম রয়েছে যারা গোলামকে ভাষা আন্দো্লনের মহান সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উমর তার এক কলামে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ক্যাসেটটিতে ভাষা আন্দোলনের ওপর কিছু কথাবার্তা থাকলেও বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের দু’দফা সাক্ষাৎকার, যাতে তিনি নিজেকে ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রচেষ্টা যে কত অসৎ ও হীন এর একটা প্রমাণ হচ্ছে, এ ক্যাসেট তৈরির সময় তথ্য সহায়তা যারা করেছেন তাদের মধ্যে আমার নাম উল্লেখ। এ কাজ করার উদ্দেশ্য যে এই প্রতারণাপূর্ণ ব্যাপারটির প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার তথ্য সরবরাহ করার বিষয়টি সর্বৈব মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গোলাম আযম তার আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন তাতেও বদরুদ্দিন উমরের কথার সত্যতা মেলে। গোলাম স্বীকার করেছেন, এই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা নিতান্তই আকস্মিক। তার ভাষায়, ’৪৯-৪৯ সালে ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের নির্বাচন না হওয়ায় এ সেশনেও জিএস-এর দায়িত্ব আমার উপরই রইল। কিন্তু হলে না থাকায় আমার জন্য এ দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়লো। তাই ভারপ্রাপ্ত জিএস হিসেবে নির্বাচিত সদস্যদের একজনের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ’৪৮ এর ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করার জন্য একটি মেমোরেন্ডাম (স্মারকলিপি) রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরীর উপর (যিনি বিচারপতি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন)। একটি কমিটি স্মারকলিপিটি চূড়ান্ত করে।
ছাত্র মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর সামনে মেমোরান্ডামটি কে পাঠ করে শুনাবে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হলো। ছাত্র ইউনিয়নের ভিপির উপরই এ দায়িত্ব দেওয়া স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু স্মারকলিপিতে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক দাবি-দাওয়ার তালিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ থাকায় সবাই একমত হলো যে, ঐ পরিস্থিতিতে একজন হিন্দুর হাতে প্রধানমন্ত্রীকে তা পেশ করা মোটেই সমীচীন নয়। কারণ মুসলিম লীগ সরকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পেছনে হিন্দুদের হাত আবিষ্কার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হিসেবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে ছাত্রইউনিয়নের জিএস গোলাম আযমকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ’ (জীবনে যা দেখেছি, ১ম খন্ড পৃ:৯৬)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে একই বইয়ের ১৪১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছে, ‘৪৮এর ২৭ নভেম্বর প্রথম কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানকে ঢাকার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়াম গ্রাউন্ডে এক ঐতিহাসিক স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রভাষার দাবির সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক দাবি বলিষ্ঠ ভাষায় জোরালোভাবে শামিল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী যদি একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দিতেন তাহলে মঞ্চেই এর প্রতিবাদ করার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু ঝানু রাজনীতিক ভাষার বিষয়ে কিছুই না বলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সৃষ্টি হয়নি। ’
প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ৬ মার্চ রংপুর কারমাইকেল কলেজের প্রভাষক থাকা অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় গোলাম। এর স্বপক্ষে ভিন্ন কোনো সূত্রে কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে বাংলা এবং উর্দুর মধ্যে তার পক্ষপাতটুকু তার আত্মজীবনীতে অনেকবারই ফুটে উঠেছে।
এছাড়া ও এই নেতা বিভিন্ন সময় , বিভিন্ন স্থানে তার বক্তৃতা ভাষা আন্দোলানের ঘটনাকে তার জীবনের ভূল সীদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন । যার কিছু নিছে দেওয়া হলো ।
১৯৭০ সালেই সে ভাষা আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে আফসোস জানিয়ে বক্তৃতা দিয়েছে যার উল্লেখ মিলে ১৯ জুন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায়। সেখানে লেখা হয়, “পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে ১৮ই জুন (১৯৭০) এক সংবর্ধনা সভায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা। ’’
তিনি বলেন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ভুল হয়েছিল। ” (সূত্র – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ হাননান পৃষ্ঠা ৩৯৯)।
বাংলা ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সঠিক কাজ হয়নি- গোলাম আযম। (দৈনিক আজাদ, ২০ জুন, ১৯৭০)
ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণের কাহিনী, তারপর ১৯৭০ সালে তাতে অংশগ্রহণে দু:খ প্রকাশ ও ভাষা আন্দোলনকে বেঠিক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা, ১৯৯২ সালে নিজেকে ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রচার করা এবং আবার বাংলা ভাষাকে ‘খোদার সেরা দান’ হিসেবে গৌরবান্বিত করার জন্য মিথ্যায় পরিপূর্ণ যে ক্যাসেট বের করা হয়েছিলো বা এখনো তাকে একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রমাণ কারা যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে তার সবই হল তাদের জাদুর খেলা।
সার. সংক্ষেপ : পরিশেষে এইটুকুই বলবো , একটা মানুষ আন্দোলানে তার জড়িয়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে এবং সেটি ভুল হয়েছে বলে দাবী করার পরেও কিভাবে পরবর্তীতে সেই আন্দোলনের একজন সম্মুখ সারির লোক দাবী করেন সেটা আমার জানা নাই । সেই সাথে তার জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি যে অনকাঙ্খিত, ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেটিও প্রকাশ পায় তারই লেখা আত্মজীবনি কিংবা বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বক্তব্য গুলোর মাধ্যমে । যে কোন ইতিহাসকেই অতি রন্জিত করে বাড়িয়ে বলা যেমন অন্যায় , তেমননি যতটুকু ঘটেছে সেটি অস্বীকার করাও অন্যায় । ঠিক একই ভাবে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভুমিকা নিয়েও আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীরা যেভাবে প্রকাশ করে সেটিও অতি রন্জিত বলেই প্রমাণ পাওয়া মিলে। ইতিহাস কে চাইলেই কেউ নিজের করে নিতে পারে না । ইতিহাস নিজ থেকেই সামনে চলে আসে ।।